লেবেদফের দুর্গা

সেটা ঊনবিংশ শতাব্দীর একদম গোড়ার কথা। আধা তৈরী ‘অবভোদনি’ ক্যানালের পাশ দিয়ে আনমনে হেঁটে চলেছেন এক তরুণ যুবক – আন্দ্রেই মিখালভ। বাল্টিক সাগরের হাওয়া তার সোনালী চুল ঘেঁটে দিচ্ছে। অনেকদূর থেকে তিনি ছুটে এসেছেন সেন্ট পিটসবার্গে শুধুমাত্র প্রাচ্যবিদ জেরাসিম লেবেদফের সঙ্গে দেখা করতে। প্রায় বারো বছর ভারতবর্ষে কাটিয়ে সেন্ট পিটসবার্গে লেবেদফ খুলেছেন সংস্কৃত প্রেস। ভারতীয় ব্রাহ্মণসমাজের গোপন প্রথা ও আচারের উপর একটা বই-ও লিখেছেন।  প্রায় দশ বছর কলকাতায় থাকার ফলে সেই বই-এর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে তৎকালীন বঙ্গীয় উচ্চারণ ধারার প্রভাব। ভারতীয় বহুত্ত্ববাদের সাথে পাশ্চাত্যের ঈশ্বরবাদের তুলনা টানতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছেন পদে পদে। সে বই তীব্র আলোচিত ও সমালোচিত গুণীজন মহলে। তবে সে বই নয়, আন্দ্রেইকে টেনে এনেছে – লেবেদফের আঁকা এক ভারতীয় দেবীর ছবি। একটি বইকে সৃজন করতে গিয়ে এঁকেছেন জেরাসিম। সেই দেবীর অনেকগুলো হাত, তাও কাঁধ থেকে নয় – কনুই থেকে। একটা হাতে একটা বেহালা আর অন্য একটা হাতে একটা মদের বোতল। সে ছবি দেখে কয়েক রাত ঘুমোতে পারেনি আন্দ্রেই। ভারতবর্ষ পৃথিবীর প্রাচীনতম জ্ঞানের গোপনতম ভান্ডার যেখান থেকে মানবিকতার জন্ম হয়েছে – এই ছিল তার বিশ্বাস। সেই দেশের এক দেবীর হাতে পাশ্চাত্যের বাদ্যযন্ত্র এবং বোতল – এ তার কল্পনাকে ছিন্নভিন্ন করছিল। লেবেদফের প্রেসের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে প্রশ্নগুলোকে মনের মধ্যে সাজিয়ে নিলেন তিনি।

সসম্মানে ডেকে নিয়ে বসালেন লেবেদফ। বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই হলেও দিব্যি সুঠাম চেহারা। প্রশস্ত কপালের নীচে চোখদুটো শান্ত, গভীর। গলা নামিয়ে স্বগতোক্তি করলেন, “আমার দুর্গা, দেখেছি তাকে”। ঘর জোড়া নৈঃশব্দ। বাইরের ঠান্ডা হাওয়ার জের যেন ইতালীয় বাস্তুকারদের যাবতীয় প্রযুক্তিকে হার মানিয়ে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লেবেদফ বলে চলেছেন তার জীবনের গল্প – রানী ক্যাথরিণের দাসপ্রথা নির্ভর শাসনব্যবস্থার মধ্যেও মাত্র ১৫ বছর বয়সে সেন্ট পিটসবার্গে আসা, নিজে নিজেই ভায়োলিন আর চেলো শেখা, রাষ্ট্রদূত কাউন্ট রাজুমভস্কি-র সঙ্গীতপার্ষদদের দলের অন্যতম সদস্যপদ পাওয়া এবং সেই সুবাদে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে সঙ্গীত পরিবেশন করার অভিজ্ঞতা। তারপর একদিন হঠাৎ দেশছাড়া হয়ে ভবঘুরের মত ইউরোপ সফর করতে করতে ইংলিশ মিলিটারী ব্যান্ডে চাকরী নেওয়া। সেই চাকরীসূত্রেই পাড়ি দিলেন ভারতবর্ষে। সেটা ১৭৮৫। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তখন জাঁকিয়ে বসছে ভারতের মাটিতে। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে পশ্চিম উপকূলে কোনঠাসা করে ফরাসীদের ইউরোপের সাত-বছরের যুদ্ধে হারিয়ে ঘাঁটি গেড়েছে পূর্ব উপকূলে। পলাশীর যুদ্ধে জয়ের ফলে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা থেকে শুরু করে গঙ্গা-যমুনা উপত্যকা, বুন্দেলখন্ডের একাংশ হয়ে গুজরাট অবধি শাসনভার তুলে নিচ্ছে হাতে।  কলকাতায় কোম্পানীর নিজস্ব সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশ থাকত। লেবেদফ প্রথম দু’বছর মাদ্রাজে কাটিয়ে চলে এলেন কলকাতায়। আস্তানা হল ডোমতলায় (বর্তমানে এজরা স্ট্রীট)।

‘হতে পারি আর্মিব্যান্ডের বাজিয়ে, আসলে তো আমি গিয়েছি ভারতবর্ষকে চিনতে’, ধীরে ধীরে বললেন প্রৌঢ়।  আন্দ্রেই শুনছেন মন্ত্রমুগ্ধের মত। ‘যদি স্থানীয় ভাষা না শিখি, তাদের রীতি রেওয়াজ না বুঝি কি করে দেশটাকে চিনবো? এই সময় আমার আলাপ হয় গোলকনাথ পন্ডিতের সাথে। আসল নাম গোলকনাথ দাস। আমাদের মধ্যে একটা চুক্তি হয়। আমি পন্ডিতকে বেহালা শেখাব আর পন্ডিত আমাকে বাংলা, সংস্কৃত, পুরাণ আর হিন্দুস্থানী রাগসঙ্গীত শেখাবে। আমরা দু’জনেই দুজনের ভাষা তেমন বুঝতাম না তাও আমাদের শেখা আটকায় নি’। ‘কিন্তু ওই দেবী?!’ – একটু চঞ্চল হয়ে পড়েন আন্দ্রেই। ‘জানো ওদেশে ভার্জিন মেরীকে কি বলে? কেউ বলে কালী, কেউ বলে দুর্গা’। ‘দুটো নাম কেন?’ – আন্দ্রেই নড়েচড়ে বসেন। ‘শুধু দুটো? আরো অনেক অনেক নাম আছে। ওদেশে মহিলার মূর্তি পূজিত হয়, কিন্তু সমাজে মহিলার অবস্থান খুব খারাপ। ওদেশের মহিলারা হয় অন্তঃপুরে থাকেন বা বারবনিতা। প্রথম যখন দুর্গামূর্তি দেখি অবাক হয়েছিলাম। লোকাচারে প্রাকৃতিক শক্তির কি কল্পনা! অনেকগুলো হাত, তাতে বিভিন্ন অস্ত্র। অশুভ শক্তি নিধন করবে। অথচ দেখো  কেবল সঙ্গীতচর্চায় তাদের কোনো অধিকার নেই। যদি থাকে তা শুধুমাত্র দেহব্যবসার অঙ্গ হিসাবে? তার অন্য কোনো শখ আহ্লাদ নেই! এসব দেখে আমি একটা কান্ড করে বসলাম। ওই গোলকপন্ডিত-ও জুটল আমার সাথে।’ ধীরে ধীরে প্রৌঢ় গিয়ে দাঁড়ান জানলার সামনে।

“তুমি বোধ হয় জানো, ফিডর ভলকভকে আমি আমার থিয়েটারের শিক্ষাগুরু মানি।রানী এলিজাবেথের আমন্ত্রণে গিয়ে তার নেতৃত্বে সাধারণ মানুষের নাটক করার দায়ে আমাদের বিতাড়িত হতে হয়েছিল। আমার দেশ ছাড়ার সেটাও একটা কারণ। কলকাতায় গিয়ে দেখি সে দেশে থিয়েটার বলে কোনো বস্তু নেই। প্রসেনিয়াম কী ওখানকার মানুষ জানেই না। আমাদের ইউরোপিয়ানরা অবশ্য থিয়েটার করত। কিন্তু সেখানে ওদেশের লোকেদের অবাধ প্রবেশ ছিল না।আমি পন্ডিতকে রাজি করালাম। তার সাহায্যে দুটো নাটক অনুবাদ হল। এক- লাভ ইজ দ্য বেস্ট ডক্টর আর দুই- দ্য ডিসগাইস।এরপর অভিনেতা খোঁজার পালা। ওদেশে কখনো থিয়েটরে মহিলারা অভিনয় করেন নি। আমি তো ছাড়বো না। হানা দিলাম বিভিন্ন পতিতালয়ে। তোমাকে কি বলবো আন্দ্রেই- তারা ভালো করে আলিঙ্গন করতেও জানে না। সিঁটিয়ে থাকত। যেন হাতগুলো কেউ কনুই থেকে আটকে দিয়েছে। তাদের টাকার লোভ দেখিয়ে, ভালোবেসে ধীরে ধীরে তৈরী হল নাটক। আমার ওই ২৫ নম্বর গোলাবাড়ি স্ট্রীটের বাড়িতে। ওদেশের প্রথম পাব্লিক প্রসেনিয়াম থিয়েটার। আমার নামে – ‘লেবেদফ’ থিয়েটার হলে। সেই নাটকে গান লিখলেন –বিখ্যাত কবি ভারতচন্দ্র রায়। সে কি উত্তেজনা! ইউরোপীয়ান থিয়েটারের থেকেও বেশি মূল্যের টিকিট কিন্তু প্রথমদিন-ই হাউসফুল। তার পরের দিনও তাই। বৃটিশরা প্রমাদ গুনল। সাধারণ মানুষ যদি থিয়েটার শিখে যায় তার ফল সে সুদূরপ্রসারী এটা ওরা বেশ বুঝলেন। আক্রমণ  নেমে এল ‘লেবেদফ’ থিয়েটার হলের উপর। সব ভেঙেচুরে ধ্বংসস্তুপ বানিয়ে দিল। আমি তখন প্রায় কপর্দকশূণ্য। পালিয়ে এলাম ওদেশ থেকে। থিয়েটার গেল তা নিয়ে আক্ষেপ নেই। মন রয়ে গেল সেই মেয়েগুলোর কাছে। এক প্রাচীন সভ্যতার কী নিদারুণ রূপ। অশূভ শক্তির বিনাশে তাকে মূর্তি বানিয়ে প্রার্থনা করা যায়।সমাজের সব থেকে এগিয়ে থাকা ব্রাহ্মণরা সেই পুজার কান্ডারী হয়ে মান, প্রতিপত্তি সব পান। অথচ তারা পড়ে থাকে ব্রাত্য হয়ে। তাই ফিরে এসে এঁকেছিলাম ওই ছবি’।

লেখক: ওঙ্কার প্রসাদ ঘোষ ( নাট্যকর্মী,  রাসবিহারী শৈলুষিক,  কলকাতা )

5 thoughts on “লেবেদফের দুর্গা

Leave a comment