Select Page

প্রেক্ষাগৃহ প্রেক্ষিত: সিনেমা হলের ক্রমহ্রাসমানতা ও চলচ্চিত্র সেবন

প্রেক্ষাগৃহ প্রেক্ষিত: সিনেমা হলের ক্রমহ্রাসমানতা ও চলচ্চিত্র সেবন

মূলভাব

সিনেমা হলে সিনেমা দেখার সংস্কৃতি বাংলাদেশের গঠমান নগর-জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হিসেবে বজায় ছিল, খুব সাম্প্রতিক অতীতেও। শেষ এক-দেড় দশকের বাংলাদেশে সিনেমা হলগুলোর দুরাবস্থা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়ে থাকে। শিক্ষিত শ্রেণীর সিনেমা হল থেকে দূরে থাকার প্রধান দুইটি কারণের একটি হিসেবে এটি উল্লেখ করা হয়ে থাকে; অপর যেটি উল্লেখ করা হয় তা হলো সিনেমার মান। অতি সম্প্রতি প্রাযুক্তিক রূপান্তরের প্রেক্ষিতে সিনেমা হলগুলো আবার মনোযোগে আসে। তবে তা নতুন প্রযুক্তি ও ভোগপ্রণালীর মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসে। বর্তমান গবেষণাটি ক্রমহ্রাসমানতার ও লাগাতার বদলের এই পরিস্থিতিকে সাংস্কৃতিক ও ব্যবস্থাপনাগত দিক থেকে দেখার একটা প্রচেষ্টা।

আশির দশক ও নতুন শতকে শ্যামলী সিনেমা হলের দুই রূপ

পটভূমি ও ধারণায়ন

বাংলা সিনেমা নিয়ে আলাপ-আলোচনাগুলো বহু তর্কে বিভক্ত। মূলত যে তর্কটি গত কয়েক বছরে মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো রুচি বিষয়ক, বা শ্লীলতা বিষয়ক। মধ্যবিত্ত বা শিক্ষিত চিন্তকবর্গের একটা দুশ্চিন্তা হলো বাংলাদেশ চলচ্চিত্র কারখানার সিনেমাগুলো ‘অশ্লীল’। গতে দেড়-দুই দশক ধরে চলচ্চিত্র বিষয়ক আলাপ-আলোচনার মূল সুর এই বিষয় নিয়ে আবর্তিত। এমনকি আরো পুরান কালে ফিরলে, এরশাদের শাসনের শেষভাগে এসে চলচ্চিত্র-‘আন্দোলন’ বিকাশের কালেও স্বরটি মুখ্যত নন্দনকেন্দ্রিক। 

এরকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে অন্য কয়েকটি গুরুতর বিষয় নিয়ে পর্যাপ্ত আলাপ-আলোচনা বা ভাবনাচিন্তা গড়ে উঠছে না। চলচ্চিত্র বিষয়ক, অন্তত প্রাথমিকভাবে গুরুত্ববহ বলে বিবেচিত হতে পারে এমন কয়েকটা জায়গা হতে পারে: চলচ্চিত্র কর্মীদের পেশাগত রূপান্তর ও অনিশ্চয়তা; চলচ্চিত্র শ্রমিকদের সংগ্রাম ও কঠোরতা; নতুন প্রযুক্তির অভিঘাত; লগ্নিকারদের প্রবণতা বদল; বিশ্ব সিনেমার সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ; টেলিভিশনের বিস্তারে চলচ্চিত্রের ওপর প্রভাব; পরিবেশক ও প্রদর্শকদের পেশাগত রূপান্তর; সিনেমা হলগুলোর দশা; সিনেমা হলে লগ্নিকারের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি। এরকম উপলব্ধি থেকে একটা বিনম্র এথনোগ্রাফীয় গবেষণা হিসেবে বর্তমান গবেষণার সূত্রপাত।

গত কয়েক বছরে প্রযুক্তির বিকাশ অন্তত মোটাদাগে দুটো ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়: চিত্রায়ন ও প্রদর্শন। এর বাইরে সম্পাদনা তথা এডিটিংয়ে বিস্তর বদলের বিষয়ে আলাপ করা যায়। আপাতত সংক্ষেপে আলোচনার স্বার্থে চিত্রায়ন ও প্রদর্শনের বিষয়ে উল্লেখ করা হলো এই কারণে যে প্রেক্ষাগৃহ তথা সিনেমা হলের সঙ্গে এই বদল দুটোর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। যে প্রদর্শন যন্ত্র দিয়ে সিনেমা হলগুলো বহু বছর চলে আসছিল সেই যন্ত্র পুরাতন এনালগভিত্তিক সেলুলয়েড চলচ্চিত্র প্রদর্শন করতে সমর্থ ছিল। যদি সেলুলয়েড উৎপাদন নিরন্তর জারিও থাকত, তাহলেও সেসব যন্ত্র অধিকাংশই অচল হবার পথে। সেসব যন্ত্রের আধুনিকায়ন অতি জরুরি হয়ে পড়েছিল অধিকাংশ প্রেক্ষাগৃহে। বাস্তবে চলচ্চিত্র উৎপাদন মুখ্যত ডিজিটাল ধারায় হতে শুরু করার কারণে এমনিতেই সেসব প্রদর্শন-যন্ত্র বদলানোর আশু প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

প্রাযুক্তিক এই বাস্তবতায় বেশ কিছু বাণিজ্যিক সংস্থা নয়া প্রদর্শন-যন্ত্র আমদানি করে প্রায় বাধ্যতামূলকভাবে হলগুলোর কর্তৃপক্ষকে সেসব যন্ত্র ভাড়া নেওয়াচ্ছিলেন গত কয়েক বছর ধরে। অন্যদিকে, হলের মালিকদের মোটা টাকা লগ্নি করে এই যন্ত্র খরিদ করার ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র শিল্পের ভবিষ্যৎ ও লাভালাভ বিবেচনা করতে হচ্ছিল। অনেক লগ্নিকারই বিগত বছরগুলোতে চলচ্চিত্র খাত থেকে মনোযোগ সরিয়ে ফেলেছেন। অধিকন্তু, দীর্ঘদিনের পুরাতন হলগুলো প্রদর্শন-যন্ত্র ছাড়াও পর্দা, আসন, ভবনসৌকর্য ইত্যাদি বিষয়েই যথেষ্ট মানহীন হয়ে পড়েছে। এরকম বাস্তবতায় হল চালু রাখতে হলে বাধ্যতামূলকভাবে নতুন প্রদর্শন-যন্ত্র ভাড়া নিয়ে ‘কাজ চালিয়ে’ যাওয়া ছাড়া কোনো পথ সেসব মালিক পাননি।

বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে কতগুলো সিনেমা হল রয়েছে তার হিসেব নির্ণয় সহজ কাজ নয়। প্রথমত, রাষ্ট্রীয় দপ্তরগুলোতে নিখুঁত হিসেব নেই। দ্বিতীয়ত, পুরাতন হয়ে অচল হয়ে যাবার কারণে এবং অলাভজনক বিবেচনা করে একাধিক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে; কিংবা সিনেমা ভবনটি গুদাম বা এরকম কাজে ব্যবহৃত হয়েছে; কিংবা সিনেমা হলের জায়গাটি অন্য কোনো বাণিজ্যে নিয়োজিত হয়েছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে বন্ধ হয়ে-যাওয়া হল পুনর্বার নতুন ডিজিটাল প্রদর্শন-যন্ত্র নিয়ে জোড়াতালিভাবে চালু হয়েছে। এরকম বাস্তবতায় সিনেমা হলের সংখ্যা নির্ধারণ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতি সম্প্রতি সরকার সিনেমা প্রদর্শনকে শুল্কমুক্ত করবার ঘোষণা দিয়ে এবং সিনেমা হলকে পৃষ্ঠপোষকতা করবার অঙ্গীকার করে পুরো পরিস্থিতির একটা বদলের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে এসব বাস্তবায়িত হবার অনেক পথ বাকি। আর অনেক ঘোষণার মতোই এটিও অধিক-পলিসি এবং অত্যল্প বাস্তবায়নের দশায় থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

ঢাকা শহরে “ঐতিহ্যবাহী” হলগুলোর বেশ কিছু হয় বন্ধ হয়েছে, নতুবা নতুন প্রদর্শন-প্রযুক্তি ও স্থাপত্য নিয়ে ভিন্নভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু সেটা সারা বাংলাদেশের সিনেমা হলের যে অবলোপন সেই বাস্তবতার বাইরে এঁকে অনুধাবনের সুযোগ নেই। বর্তমান গবেষণাটি ঢাকার ও বাইরের কয়েকটি সিনেমা হলে মনোযোগ দিয়ে এই বৃহত্তর বাস্তবতার একটি চিত্র আঁকতে প্রয়াসী মাত্র।

কেন্দ্রীয় জিজ্ঞাসা

এই গবেষণার মূল লক্ষ্য সিনেমা হল ও সিনেমা-ভোগের সংস্কৃতির বদলকে শনাক্ত করা। গবেষণার একদম প্রাথমিক অনুধাবন-কালে সাব্যস্ত করা হয়েছিল ঢাকার কয়েকটি সিনেমা হলের কেইস-অধ্যয়ন এই গবেষণার মুখ্য বৈশিষ্ট্য হবে, সাথে ঢাকার বাইরের কিছু সিনেমা-হলকে তুল্যবিচারে বিবেচনা করার কথা বিবেচিত ছিল। করোনার সামগ্রিক পরিস্থিতি মাঠকর্মকে প্রভাবিত করলেও গবেষণার মুখ্য জিজ্ঞাসাগুলো অটুট। গবেষণাটি কতগুলো কেন্দ্রীয় জিজ্ঞাসার ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে প্রতীয়মান হয়। সেগুলো হচ্ছে:

১। সিনেমা দেখার সংস্কৃতি কীভাবে দাঁড়িয়েছিল?

২। অপেক্ষাকৃত ছোট শহর বা মফস্বলে সেই সংস্কৃতির প্রভাব বা প্রতিফলন কী?

৩। সিনেমা হলে মুখ্যত কারা সিনেমা দেখতে যেতেন?

৪। হল দর্শকদের সামাজিক গোষ্ঠী ও শ্রেণীতে গুরুতর কোনো রূপান্তর কি হয়েছে?

৫। হলের ছবি বাছাই হয় কী প্রক্রিয়ায়?

৬। ছায়াছবি উৎপাদন প্রক্রিয়ার রদবদলের সঙ্গে সিনেমা হলের সম্বন্ধ কেমন?

৭। হলের স্থাপত্য ও স্থাপনার মুখ্য বৈশিষ্ট্য কী?

৮। কোন ধরনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক কালে সিনেমা হল যাচ্ছে?

৯। মধ্যবিত্তীয় সিনেমা-সংস্কৃতির সাম্প্রতিক প্রবণতাগুলো কী কী?

১০। প্রাযুক্তিক বিকাশ ভিজ্যুয়ালের সঙ্গে সম্পর্কের কী ধরনের বদল এনেছে?

অনুধাবনের সময়কালেই এর সবগুলো মীমাংসাযোগ্য গবেষণা করতে যাচ্ছি তা ভাবিনি। কিংবা অনুসন্ধানের পরিধি এতটা রাখা যাবে না সেটাও অনুমানে ছিল। তবে ভাবনাচিন্তার পাটাতনে প্রাসঙ্গিক জিজ্ঞাসাগুলো একত্রিত করা একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুশীলন হিসাবে বিবেচনা করে জিজ্ঞাসাগুলোকে সমন্বিত করেছি। কোনো কোনোটিকে অন্যগুলোর তুলনায় এই গবেষণাতে অধিক কেন্দ্রে রেখে আগিয়েছি। যেমন ১, কিংবা ৪, কিংবা ৭ বা ১০। ফিল্ডের সঙ্গে গুরুতর বদল ঘটে গেছে সাম্প্রতিক মহামারী/অতিমারীর কারণে। আবার জিজ্ঞাসাগুলো নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্নভাবে আমার যোগাযোগ ঘটেছে বক্তা বা বিশ্লেষক হিসাবে। এমনকি কিছুটা হেঁয়ালি মনে হলেও, এই গবেষণার পরিক্রমাতেই, জিজ্ঞাসা পরিসীমিত হয়েছে, বলা চলে, ‘কোন সিনেমা’ ‘কার সিনেমা’ ‘কোথায় সিনেমা’তে।

গাজীপুরের চম্পাকলি

পদ্ধতি

গবেষণাটিতে নিবিড় পর্যবেক্ষণ রীতি অত্যাবশ্যক ছিল। ধ্রপদী নৃবিজ্ঞানে অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ নিয়ে যে অর্থে আলাপ হয়েছে তা অনেকাংশে কিতাবী থেকে গেছে। বাস্তবে অনেক চিন্তকই মনে করেন কিতাবী ব্যাখ্যানুসারে অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ নিয়ে যাই বলা হয়ে থাকুক না কেন, অনুশীলন হিসেবে তা অবাস্তব এবং অসাধ্য, অন্তত এই কারণেও যে নৃবিজ্ঞানী আসেন অন্য গোষ্ঠী, শ্রেণী বা জাতি থেকে আর সর্বাত্মক অন্তর্ভুক্তি সম্ভব নয়। আরও গভীর ক্রিটিক্যাল নৃবিজ্ঞান বা সামাজিক বিজ্ঞান এরকম সর্বাত্মক কথিত অন্তর্ভুক্তি জরুরিও মনে করে না, বরং বিপজ্জনক প্রচারণা মনে করে। প্রতিবর্তী বা রিফ্লেক্সিভ গবেষণা বরং এসব ক্রিটিকের সুপারিশ। নিবিড় পর্যবেক্ষণ বলতে এখানে সপ্রশ্ন ও ক্রিটিক্যাল অনুধাবনের জন্য বাস্তব মাঠে অনুসন্ধানই বুঝিয়েছি। গত বছরে মহামারীজনিত মাঠ গবেষণার রদবদলের পরও ভেবেছিলাম, পরিস্থিতি বদলাবে এবং এই গবেষণায় কথিত ‘নিবিড় পর্যবেক্ষণ’-এর কেন্দ্রীয় ভূমিকা থাকবে। বাস্তবে তা সম্ভব হয়নি। কিছু অংশে  আমার অন্য সময়ে কৃত মাঠকর্মের ওপর ভরসা করেছি। আবার কিছু ক্ষেত্রে নেটিজেনদের সঙ্গে সংমিশ্রিত বা প্রতিবর্তী আলাপ করেছি যাকে একটা মুখ্য পদ্ধতি বলছি। তবে এর মধ্যেও একাধিক বন্ধ সিনেমা হলকেও ‘মাঠ’ সাব্যস্ত করে কাজ করেছি।

তবে পরিহাসময় বা আয়রনিক হলো খোদ করোনার পরিস্থিতি সিনেমা উৎপাদন ও ভোগপ্রণালীর গুরুতর রদবদল ঘটে গোটা বিশ্বেই। এই বদলের মাত্রা ও স্বরূপ বহুবিধ। একদিকে প্রযুক্তি, অন্যদিকে ভোক্তাবৃদ্ধি, আবার বিষয়বস্তু, অন্যদিকে সর্বাত্মক ভোগপ্রণালীর বদল – সব মিলে সামগ্রিক চলচ্চিত্রের সর্বাত্মক বদল ঘটেছে; এমনকি খোদ এই মহামারীর মধ্যেই। মধ্যবিত্তের ভিজ্যুয়াল দুনিয়ার এই সর্বাত্মক বদলকে বিবেচনায় রাখলে চলচ্চিত্র বিষয়ক গবেষণাগুলোর আগাগোড়া এজেন্ডা-বদল ঘটছে ধরে নেয়া যায়। ফলে, খোদ ‘গবেষণা-ক্ষেত্র’ হিসাবে প্রেক্ষাগৃহের অস্তিত্বকে পুনর্ভাবনা দেয়া দরকার। বস্তুত, সাইবারস্পেসই বরং চলচ্চিত্র বিষয়ক গবেষণাগুলোর প্রধান পরিক্ষেত্র/ফিল্ড বিবেচিত হওয়া দরকার। তবে এই গবেষণার মুখ্য জায়গা হিসাবে ভৌত পরিসরের প্রেক্ষাগৃহ গুরুত্বপূর্ণ অনুধাবিত ছিল বিধায় সেভাবেই গবেষণাটির মূল কাঠামো বজায় রাখা হয়েছে।      

বাংলাদেশের বিভিন্ন সিনেমা হলের নানাবিধ সমস্যার কথা পত্রিকান্তরে কিংবা লোকমুখে জানা হয়ে থাকে। এসবের খোঁজখবরের জন্য একটা জরিপ বা সার্ভে করতে পারলে অত্যন্ত ভালো হতো। প্রথাগত জরিপের থেকে গুণগত গবেষণার জরিপ খুবই আলাদাও বটে। কিন্তু এরকম একটা জরিপ সম্পাদন করা মোটেই সহজ নয়। বস্তুত বাংলাদেশে চলচ্চিত্র বিষয়ে অনেক পেশাগত ও বড় মাপের গবেষণা প্রকল্পও এরকম জরিপ সম্পাদন করে উঠতে সমর্থ হয়নি। তবে সেরকম সুলভ কোনো জরিপ থাকলে সেটিকে এই গবেষণায় ব্যবহার করা হবে। গত কয়েক বছরে ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক পর্যায়ে আমি নানান সময়ে শুনেছি যে প্রেক্ষাগৃক বা সিনেমা হলগুলোর একটা পরিব্যপ্ত জরিপ কাজ করার তাগিদ তাঁরা বোধ করেন। বাস্তবে সেটা সম্ভব হয়নি। এই গবেষণায় কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল যাতে অন্তত তিন-চারটা জেলার সিনেমা হলের জরিপ করা যায়। করোনা-পরিস্থিতিতে তা কাঙ্ক্ষিতভাবে সম্পন্ন হয়নি। 

নিবিড় সাক্ষাৎকার কিংবা অকাঠামোবদ্ধ সাক্ষাৎকার প্রধান তথ্যসংগ্রাহক কৌশল হবার কথা ছিল। গবেষক হিসেবে আমি প্রথাগত সাক্ষাৎকার থেকে প্রতিবর্তী আলাপচারিতা (রিফ্লেক্সিভ কনভার্সেশন) দক্ষ ও কার্যকরী উপায় মনে করি। সিনেমা হলের মালিক, হল কর্মচারীদের সঙ্গে যেমন আলাপচারিতার পরিকল্পনা ছিল, তেমনি দর্শকদের সঙ্গেও মুখোমুখি আলাপচারিতার বিশদ পরিকল্পনা ছিল। এ সকল আলোচনার মূল লক্ষ্য ধার্য করা হয়েছিল সিনেমা হল ও সিনেমা দেখার অনুশীলনের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক অনুসন্ধান। এর সূত্র ধরেই কয়েকটি সিনেমা হলকে প্রাথমিক তালিকায় রেখেছিলাম। আর সেগুলোর গতিপ্রকৃতি এবং মহানগরের সামগ্রিক বিনোদন পরিস্থিতি বোঝার মূল উদ্দেশ্যে তাঁদের সঙ্গে রিফ্লেক্সিভ আলাপচারিতার উদ্দেশ্য ছিল। স্বাস্থ্য পরিস্থিতির কারণে সকল কিছু বন্ধ থাকার মধ্যে এসব আলাপের একটা বিরাট অংশ সাইবার-মাধ্যমে সাধিত হয়েছে।

সামাজিক ইতিহাস বলে যে গবেষণাদির কথা বলা হয়ে থাকে, তা যতটা পদ্ধতি ততটাই উদ্দেশ্য, আবার রচনাশৈলী। অত্যন্ত ছোট পরিসরে, এই গবেষণাটি সামাজিক ইতিহাসের একটি দলিল হবারও চেষ্টা করেছিল। যদি অপরাপর আন্তরিক উদ্যোগগুলোর মধ্যে মিলিয়ে পড়া হয়, তাহলে স্বল্পাকার এই গবেষণাটিকেও মনোযোগী পাঠকের সামাজিক ইতিহাস প্রচেষ্টার আন্তরিক কারিগর মনে হবে।

গবেষণাটি মুখ্যত ঢাকা শহরে সাধিত হবার কথা থাকলেও, সমান্তরাল একটা পরিকল্পনা ছিল টঙ্গী বা সাভারের মতো ঢাকার অদূরবর্তী শহরগুলোতে এবং অন্যান্য জেলা শহরগুলোতেও সিনেমা হল বিবেচনায় রাখব। বাস্তবতার সার্বিক ও তুল্য চিত্র বুঝতে এরকম ভেবেছিলাম। যদিও নির্দিষ্ট সিনেমা হলসমূহ আমি বাছাই করিনি, তবে লোকমুখে ‘ঐতিহ্যবাহী’ হিসেবে পরিচিত সিনেমা হলগুলোর দিকে আমার বাড়তি মনোযোগ ছিল। আবার স্থাপত্য ও ঘনত্বের চ্যালেঞ্জ বিবেচনা করে তুলনামূলক ‘পুরান ঢাকা’র সিনেমা হলগুলোকেও প্রাথমিক তালিকায় রেখেছিলাম। ‘মধুমিতা’, ‘অভিসার’, ‘জোনাকী’, ‘রাজমণি’, ‘এশিয়া’, ‘সনি’, ‘শ্যামলী’, ‘পর্বত’ থেকে শুরু করে টঙ্গী-গাজীপুরের ‘আনারকলি’, ‘চম্পাকলি’, ‘চাঁদনী’ থেকে সাভারের ‘বিলাস’ কিংবা খুলনার ‘সঙ্গীতা’ সবই প্রাথমিক বিবেচনায় ছিল। পরিস্থিতির বদলের পর এসব পরিকল্পনার বিস্তর রদবদল ঘটাতে হয়। যে চারটা সনাতনী সিনেমা হলকে এই গবেষণার কেন্দ্রীয় ভৌত ‘গবেষণা-ক্ষেত্র’ বলা চলে সেগুলো হচ্ছে: ঢাকার শ্যামলী ও বলাকা, টঙ্গীর ‘আনারকলি’ (গবেষণা চলাকালীন সময়েই সর্বাত্মক ধ্বংসপ্রাপ্ত), খুলনার ‘সঙ্গীতা’। এসব সিনেমা হলের পরিপার্শ্ব, সংশ্লিষ্ট মানুষজন, ভোক্তাসমেতই এগুলো গবেষণাস্থল।

পণ্য হিসাবে ভূমির পুনর্জাগরণ

এই অংশটিকে ব্যাখ্যা করবার জন্য আসলে ঠিক কোন গুরুত্বে রাখব তা গবেষণা ফলাফল লিখবার সময় বিশদ ভাবতে হয়েছে। এই সূচির চতুর্থ অনুচ্ছেদকেই প্রথম রাখবার একটা বাড়তি তাগিদ বোধ করছিলাম। সেটা এই কারণে যে অল্প হলেও সিনেমা হলগুলোর বিপর্যয় নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলাপ আছে। সেই আলাপগুলো কমবেশি মধ্যবিত্ত চলচ্চিত্রপ্রেমীদের দৈনন্দিন জীবনে ছিল, তেমনি ছিল দৈনিক বা অন্যান্য প্রকাশনাতে। বিশেষজ্ঞীয় আলাপ-আলোচনাতেও কিছু প্রসঙ্গ উপস্থিত হয়েছে। সেগুলো কমবেশি চলচ্চিত্র সংসদীয় প্রকাশনাতে এবং তাঁদের নিজস্ব সভাসমিতিতে প্রকাশিত। যতটা গুরুত্বের সাথে এই প্রসঙ্গে আলাপ হবার দরকার ছিল তা হয়নি। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে যেসব বিশ্লেষণ থাকা দরকার ছিল সেসবের থেকে বহুদূরে তাঁদের বিশ্লেষণ। সেসব বিশ্লেষণকে পরিশেষে অপেক্ষাকৃত পরে সংযোজনের সিদ্ধান্ত নিলাম।

একটা সিনেমা হল, বিশেষত মফস্বলের, মহকুমা বা থানা শহরের, সিনেমা হলের জন্য ২ থেকে ৫ বিঘা জমি ব্যবহার হয়ে থেকেছে। প্রায়শই এই সিনেমা হলগুলো বাজারসংলগ্ন, কিংবা বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন। সেটা হোক বা না হোক, সাধারণভাবেই কোনো লোকালয়ে অন্তত একটা মহাসড়কের ধারে সিনেমা হল প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং খোদ সিনেমা হলকে উপলক্ষ করেই একটা বাসস্টপ দাঁড়িয়ে যায়। একটা মহল্লা বা চত্বরের নামকরণও গড়ে ওঠে সিনেমা হলটিকে ঘিরে। এগুলো অত্যন্ত পুরান প্রপঞ্চ। খুব সাধারণ প্রবণতা হিসাবেও যদি লক্ষ্য করা যায় তাহলে মফস্বল বা ছোট শহরের প্রায় প্রত্যেকটিতে সিনেমা হলকে কেন্দ্র করে একটা মহল্লার নাম, এবং অপেক্ষাকৃত বড় শহরে বাসস্ট্যান্ড গড়ে উঠেছে। ২ থেকে ৫ বিঘার হিসাবটা প্রেক্ষাগৃহের আসনসংখ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত। যশোরের বিখ্যাত মণিহার সিনেমা হলকে বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের বৃহত্তম হল। এটাতে ব্যবহৃত জমির পরিমাণ ছিল ৪ বিঘা। বৃহত্তম বলতে এখানে আসন সংখ্যা ও মূল প্রেক্ষাগৃহের আয়তনের হিসাব বোঝানো হয়েছে। কিন্তু মূল প্রেক্ষাগৃহ ভবন ছাড়াও আশপাশের চত্বর একেকটা সিনেমা হলের একেক ধরনের হয়ে থাকে। সাধারণত এসব চত্বরে একটা বিপণনমূলক স্থাপনা গড়ে ওঠে। সব মিলে প্রেক্ষাগৃহের চত্বরের জমির পরিমাণ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভূমির মূল্য আচমকা বিবর্ধিত হবার পর ছায়াছবির বাজার পড়ে যাবার সম্পূর্ণ ভিন্ন গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। একটা জমির খণ্ড আচমকা তখন নতুনভাবে অনুধাবিত হচ্ছে। চলচ্চিত্রের দর্শক যখন প্রেক্ষাগৃহে আসতেন তখন এই জমির মূল্যমানের প্রসঙ্গ ছিল ছবির বাজার নির্ভর। যে মুহূর্তে সেই বাজার পড়ে গেছে সিনেমা হলের জমিটি তার স্থাপনাপূর্ব জমিতে পর্যবসিত হয়েছে। এখানে সিনেমা হলের পরিপার্শ্বে যেসব দোকানপাট পরিষেবা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল সেগুলোর প্রসঙ্গও গুরুত্বের সঙ্গে আনতে হবে। দু’তিন দশক ধরে অতীতে চলমান সিনেমা তৎপরতার মধ্যে এসব দোকানপাট ও পরিষেবার একটা চলমান তালিকা হতে পারে এরকম: স্ন্যাকস খাবারের দোকান, আইসক্রিমের দোকান, দ্রুতগতির রেঁস্তোরা, ফটোকপি ও স্টেশনারি, ফটো স্টুডিও, পুরুষদের চুল কাটার সেলুন, নারীদের সৌন্দর্য সেলুন, ইত্যাদি। কিছু বিরল ক্ষেত্রে, অন্তত মফস্বলে, সিনেমা চত্বরে একই মালিকের কিংবা ব্যবসায়ী মিত্র কারো একটা আবাসিক হোটেলও থাকতে পারে; এমনকি কোনো কাঁচামালের গুদাম বা আড়ৎও সিনেমা হলের চত্বর কিংবা সংলগ্ন থাকতে পারে। শেষোক্তগুলোর হিসাব, হোটেল বা আড়তের, খুবই স্বতন্ত্র। অন্য সকল পণ্য বা পরিষেবাই গভীরভাবে সিনেমা হলে জনসমাগমের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেসব বন্ধ হবার পথে অধিকাংশ সিনেমা হলেই।             

জমির প্রসঙ্গটাও গুরুত্বপূর্ণ এবং আয়রনিক্যালি সম্পর্কিত। ছোট শহরে সিনেমা বিকাশের কালে একাধিক নজির আছে যেখানে ফসলী জমি অধিগ্রহণ করে সিনেমা হল বিকশিত হয়েছে। বলাই বাহুল্য যে ফসলী জমিতে কয়েক বিঘা সিনেমা হল করার কারণে মুনাফা বৃদ্ধি ঘটেছে। এখনো যে সারা দেশে নির্মিত বাড়ির ব্যবসা চলছে সেগুলোর মূল হিসাব আসলে মুনাফাবৃদ্ধি। ছোট শহরে নানান গুদাম বা আড়ৎ তৈরি হবারও নজির আছে এসব ফসলী জমিতে, কিংবা তামাক বিকাশ কালে তামাক পোড়ানো ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জায়গা। জমির মূল্যের একটা পুনর্মূল্যায়িত দশার কারণে সিনেমা হলে দর্শকের কমতি সহজেই সিনেমা হল মালিকদের নতুন করে জমিটার উপযোগিতা নিয়ে ভাবিয়েছে। তাঁরা নতুন ধরনের বাণিজ্য সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছেন।

যশোরের মনিহার

শপিং-মলের বিস্তার ও নব-উদারতাবাদী ভোগপ্রণালী

‘শপিং-মল’ একটা জেনেরিক বর্গ হিসাবে এখানে প্রয়োগ করেছি। এখানে স্মরণ রাখা দরকার যে বিভিন্ন পদ বা প্রত্যয় বিভিন্ন সময়ে উদ্ভূত হয় এবং সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন ধরনের রূপকল্পনা হাজির করে। ‘শপিং কমপ্লেক্স’ বললে যে ধরনের স্থাপত্যরূপ কিংবা ভোক্তা-বিক্রেতা আচরণ, এমনকি পণ্যসম্ভার পাঠকের কল্পনায় আসে, তা ঠিক একই রকম ‘শপিং-মল’ শব্দের আসে না। ফলে এখানে ‘শপিং-মল’ শব্দের অধীনে কিছু আগের কালের ‘শপিং কমপ্লেক্স’ বর্গের অধীনে যা কিছু থেকেছিল সেগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত রেখেছি। আবার, বড় শহর এবং ছোট শহর উভয় এলাকাতেই সিনেমা হলের সাথে সম্পর্কিত, এমনকি একই মালিকের, শপিং কমপ্লেক্স খুবই সাধারণ ঘটনা ছিল। ঢাকা শহরের অপেক্ষাকৃত সনাতনী সিনেমা হলের মধ্যে এর উদাহরণ সুলভ ছিল, যেমন: শ্যামলী, সনি, গুলিস্তান, বিউটি, পূর্ণিমা কিংবা জোনাকী। আবার সিনেমা হলটি মুখ্যত স্বতন্ত্র এবং কোনো শপিং কমপ্লেক্সসমেত নয় এমন উদাহরণও সুলভ ছিল। যেমন, বিনাকা, বলাকা, এশিয়া, মধুমিতা, অভিসার বা পর্বত। এসব সিনেমা হলের প্রত্যেকটির পরিপার্শ্ব এবং শহরের গাঠনিক বিকাশের সঙ্গে এগুলো সম্পর্কিত। যেমন, বলাকা ও বিনাকা একই মালিকের অধীন এবং একটা অটুট চত্বরে, একই ভবনে। এর আশপাশে নিউ মার্কেট, নীলক্ষেত বাকুশাহ হকার্স মার্কেট, গাউছিয়া বাজার ইত্যাদি সম্পর্কিত। ফলে এই সিনেমা হল দুটোর পরিপার্শ্বের ‘শপিং কমপ্লেক্স’ না-থাকার বিষয়টিকে দেখতে হবে এগুলো বিবেচনা করে। পক্ষান্তরে, শ্যামলী সিনেমা হল যার বছর পাঁচেক আগে পুনর্সংস্কার হয়েছে, সেটা গোড়া থেকেই অনেকগুলো দোকানপাট এবং সিনেমা হলের একটা সমন্বয় হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। বছর কয়েক আগে শ্যামলী সিনেমা হল পরিপূর্ণ পুনর্গঠিত হয়। তখন আশপাশের দোকানগুলো, যেগুলো একটা কম্পাউন্ডেই আছে, এবং একটা ডিজাইনের অন্তর্গত, বদলায়নি। তবে সিনেমা হলটি পুনর্গঠিত হয়েছে এবং এর দেয়াল ভাগাভাগি করে এমন অনেকগুলো দোকান তৈরি করা হয়েছে। সিনেমা হলটি পূর্বতনটির তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোটমাপে নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তিসমেত আত্মপ্রকাশ করেছে; সঙ্গে একটি হালের স্থাপত্যসমেত বহুতল ‘শপিং-মল’।

মোটের ওপর, ‘শপিং কমপ্লেক্স’ কিংবা ‘শপিং মল’ সিনেমা হলগুলোকে প্রতিস্থাপন করছে। শ্যামলী সিনেমা হল সেই বিরল উদাহরণগুলোর একটা যেখানে পুনর্গঠনের সময় প্রেক্ষাগৃহটিকে বাতিল না-করে আগানো হয়েছে। গুলিস্তান কিংবা বিউটি সিনেমা হলের সর্বাত্মক বদল ঘটেছে যেখানে হলটিই আর রাখা হয়নি। এই প্রতিবেদন রচনার সময়কালে, করোনারও আগে থেকে গাবতলীর এশিয়া সিনেমা হল অনিয়মিত হয়ে পড়েছিল। করোনা পরিস্থিতি এই অনিয়মিত দশাকে আরো নিশ্চিত করেছে। এই সিনেমা হলের পুনর্গঠনের ধারণা চলছে বলে গবেষণা চলাকালীন সময়ে জানা গেছে। নতুন ভবন পরিকল্পনায় সিনেমা হলটিকে বাদ রাখা হয়েছে বলেই আশপাশের মানুষজনের ধারণা। এই সিনেমা হলের মালিক পক্ষকে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে আন্দাজ করা যায়, এই হলটির পুনর্গঠনের সময়ে সিনেমা হলটি থাকবে না, এবং সম্পূর্ণ নতুন একটা বহুতল শপিং-মল তৈরি হবে। এরকম বিশদ উদাহরণ আরো কিছু প্রেক্ষাগৃহের ক্ষেত্রে দেয়া যাবে। তবে মুখ্য প্রসঙ্গ হলো একটা সিনেমা হল যে পরিমাণ জায়গা দখল করে থাকে তাতে মহানগরের মাপে কমবেশি ৩০টা থেকে ৫০টা দোকানের স্থান সঙ্কুলান করা সম্ভব। ঢাকাতে ৩০টা দোকানের দখল-টাকা বা পজেশন-মানি কম করে হলেও ৩ কোটি টাকা। অন্যান্য বড় শহরেও এটা একটা বড় অঙ্কের টাকা। সিনেমার দর্শক পড়তির প্রেক্ষাপট আসলে নয়া-উদারতাবাদী বাণিজ্য তৎপরতার সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। সিনেমা হলের মালিকেরা নতুন দোকানপাট বসানোর তৎপরতাকে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় হিসাবে দেখছেন।

জোড়া-খুন: বিলীয়মান প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে করোনার বৈশ্বিক অভ্যুদয়

ইতিহাস খুবই অদ্ভুত; নানাবিধ মনুষ্য-কল্পনা ও সরল-ভাবনার সঙ্গে ইতিহাসের বোধ এমন পেঁচানো থাকে যে ‘সত্য’ আর ‘মনগড়া’ একাকার হয়ে পড়তে পারে। এখন থেকে এক দুই দশক পরে তখনকার বিশ্লেকেরা যদি এই সিদ্ধান্তে আসেন যে বাংলাদেশের সিনেমা হল বিপর্যয় ঘটেছে করোনা মহামারীর কারণে ও সময়কালে তাহলে আমি অবাক হব না। আমার আশঙ্কা যে এরকম বিশ্লেষণ, বেঁচে থাকলে, আমি অভিজ্ঞতা করব। বাস্তবে সেটা হবে মর্মান্তিক ধরনের মিথ্যা ইতিহাস চর্চা। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাগৃহের অবনয়ন একটা দীর্ঘকালীন ক্ষয়িষ্ণু প্রবণতা। এর সূচনা কম করেও প্রথম পর্বের ৯০ দশকের থেকে, যখন স্যাটেলাইট চ্যানেল বাংলাদেশে সম্প্রচারিত হতে শুরু করেছে। এই ধরনের বৃহৎ সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনার পর্যবসন ঘটে কয়েকটি কারণে। আমি প্রস্তাব করতে চাই যে, এর মধ্যে রয়েছে: বড় সংস্থা ও রাষ্ট্রের প্রপাগান্ডা, পাবলিক বিস্মৃতি, সরল কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের প্রবণতা ইত্যাদি। চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহ অবনয়নের প্রশ্নে এর সবগুলোই কাজ করেছে বলে আমি এই গবেষণাতে আবিষ্কার করেছি।

বাংলাদেশে কতগুলো প্রেক্ষাগৃহ চালু আছে, কিংবা অতীতে কতগুলো ছিল তা নিয়ে নির্ভরযোগ্য কিংবা পদ্ধতিগত কোনো হিসাব নেই। এই প্রসঙ্গে গবেষকদের গড়পরতা আগ্রহ অত্যন্ত কম বলে প্রতিভাত হয়েছে। অন্তত এই গবেষণা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবার অনেক আগে থেকেই, চলচ্চিত্র বিষয়ক আমার লাগাতার ভাবনা ও ‘গবেষণা’র কারণে, আমি প্রত্যক্ষ করেছি যে বৃহত্তর সাহিত্য, সমাজবিদ্যা কিংবা মিডিয়া স্টাডিজের শিক্ষার্থী-গবেষকদের পলিটিক্যাল ইকনমি নিয়ে ভাবনা দুর্বল কিংবা একদমই নেই; তাঁদের মুখ্য আগ্রহ নন্দন কিংবা শৈলী নিয়ে। পাশাপাশি এ কথাও উল্লেখ করা দরকার যে, বরং দৈনিক ও পোর্টালের বিনোদন সাংবাদিকদের বেশ নৈমিত্তিক দুর্ভাবনা লক্ষ্য করা গেছে। গুরুতর কিংবা বড় কোনো জরিপ তাঁদের পক্ষ থেকে সাধিত না হলেও তাঁরা দফায় দফায় এই প্রসঙ্গে তাঁদের ভাবনাকে প্রকাশ করেছেন। সেখানেই কিছু হিসাব-নিকাশ পাওয়া যায়। ৯০ দশকে হাজার দেড়েক চালু সিনেমা হল ছিল বলে জানা যায়। যদিও সেটা ৯০-এর শেষভাগ আসতে আসতেই ছিল কিনা তা নিশ্চিত নয়। সিনেমা হল খুব দ্রুত হারে কমতে থাকে। আগের ফলাফলগুলোকে জমির পুনর্মূল্যায়ন ও মুনাফা-লগ্নি হিসাবে সিনেমা ব্যবসার পড়তি দশা আলাপ করা হয়েছে। ২০১৮ নাগাদ ৩০০ হল চালু থাকার হিসাব মেলে। ২০১৯-এর গোড়ার দিকে সেই সংখ্যাটা কমে ২৫০ দাঁড়ায়। ২০১৯-এর নভেম্বর মাসে ওরকম মনোযোগী কোনো দৈনিক পত্রিকার বিনোদন সংবাদকর্মীর প্রতিবেদন জানায় যে নিয়মিতভাবে তখন ১৭৪টি সিনেমা হল চলছে। এর কয়েকমাস পরেই, বৈশ্বিক প্রবণতা হিসাবে করোনা ভাইরাসের প্রকোপে নানান কিছু বদল শুরু হয় ২০২০-এর মার্চ মাস থেকেই। এমনকি এরও আগে ২০২০-এর ফেব্রুয়ারি মাসের এক প্রতিবেদনে জানা যায় যে তখন নিয়মিতভাবে প্রদর্শিত হয় এমন চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা মাত্র ৭৪টি। ফলে গোড়াতেই বলে নিয়েছিলাম যে কখনো করোনাকে সিনেমা হল অবনয়নের জন্য দায়ী ভাবলে তা হবে মারাত্মক মিথ্যা ইতিহাসচর্চা। যদি করোনার প্রশাসনিক ও স্বাস্থ্যগত ব্যবস্থাপনায় আরো হল বন্ধ হয়েছে ধারণা করা হয়, তাহলে এই ১৬ মাস পর সারাদেশে বাস্তবে চালু সিনেমা হলের সংখ্যা আন্দাজ করাই মুস্কিল। মোটের ওপর বলা চলে, সিনেমা হল একটা মৃত জন-পরিসর।

‘জোড়া-খুন’-এর রূপক ব্যবহার করলেও আমার দিক থেকে স্পষ্ট করার দরকার আছে যে, করোনায় যে ধরনের রূপান্তর দর্শকদের ঘটেছে তার প্রত্যক্ষ কোনো করোনা-অভিঘাত নেই। বরং, করোনার বহু আগেই বিভিন্ন শ্রেণীর ও রুচির দর্শকেরা হল ছেড়েছেন। হলের অবনয়ন তাঁদের সংখ্যা কমার কারণ নয়, বরং দর্শক-অনুপস্থিতিই হলের সংখ্যা পর্যবসনের কারণ। মধ্যবিত্ত ড্রইংরুমকেন্দ্রিক দর্শকেরা বহু আগেই তাঁদের দৃশ্যজগতের সম্পূর্ণ রদবদল ঘটিয়েছেন। করোনা ভাইরাসের মহামারীতে সারা বিশ্বের মধ্যবিত্তের মধ্যেই চলচ্চিত্র সেবন গুরুতরভাবে বেড়েছে। এসব হিসাব-নিকাশ বৈশ্বিক পত্রপত্রিকাতেই সুলভ। আন্তর্জাতিক পোর্টাল হিসাবে নেটফ্লিক্স বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়েছে। তবে অ্যামাজন-প্রাইমও কাছাকাছি জনপ্রিয়তা নিয়ে আছে। এগুলোর চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন সিরিজের জোগান পোর্টালনির্দিষ্ট। অর্থাৎ, একটি পোর্টালে যে ছায়াছবি কিংবা সিরিজ পাওয়া যায় সেটা অন্যত্র পাওয়া যায় না। খরচ করতে হয় এমন ভারতীয় পোর্টালও খরিদ্দার পাচ্ছে। যেমন, জি-ফাইভ, হটস্পট কিংবা হৈচৈ। বাংলাদেশ থেকেও সমরূপ ব্যবসাকেন্দ্র হিসাবে পোর্টাল দাঁড়াচ্ছিল যেগুলো এখনো আইনি জটিলতা কিংবা দর্শকপ্রিয়তার বিচারে গুরুতর কোনো জায়গা এখনো তৈরি করেনি। খরচের পোর্টাল ছাড়াও ইউটিউবও চলচ্চিত্র সেবনের একটা জায়গা হিসাবে দেখা দরকার। সিনেপ্লেক্স ছাড়া আর কোনো বাস্তব পরিসরে এই দর্শক আর ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আর সিনেপ্লেক্সকে সামগ্রিক বিপণন-সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হিসাবেই দেখা দরকার।           

রাজধানীর টেকনিক্যাল মোড়ের এশিয়া সিনেমাহল

‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’: সিনেমা-শিল্প ধ্বংসের উদ্ভট মধ্যবিত্ত ব্যাখ্যা

কারণ আর ফলাফলের সম্পর্ক নির্ধারণ করা সামাজিক বিদ্যার পাঠে একটা নিত্য সঙ্কট। এটা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটা বিদ্যায়তনিক চর্চা। বিদ্যাজগতের বাইরেও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ কিংবা দর্শনের দুনিয়াতেও এই সম্পর্ক নির্ণয়ের লাগাতার প্রচেষ্টা চলে। সিনেমা শিল্প কীভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে তা নিয়ে গড়পরতা মধ্যবিত্ত আলাপ চক্রাকার এবং উদ্দেশ্যবিহীন খাপছাড়া হিসাবে আমি সাব্যস্ত করেছি। এখানে আলাদা করে মধ্যবিত্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রসঙ্গ আসছে এজন্য যে সেই ব্যাখ্যাই একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আধিপত্যশীল ভাবনা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বিষয়টা এমন যে, ব্যাখ্যাগুলো সরকারী প্রশাসকবৃন্দ থেকে শুরু করে সিনেমা হলের সামনের দোকানদারেরা পর্যন্ত, কিংবা সংবাদকর্মী থেকে শুরু করে পথচলতি দর্শক পর্যন্ত কমবেশি কাছাকাছি ভাবে বলেন। সিনেমা বিপর্যয়ের কারণগুলো হাজির করতে এঁরা সমধর্মী ব্যাখ্যাই করে থাকেন। তবে প্রাথমিকভাবে সিনেমা-শিল্পের ধ্বংসপ্রাপ্তি বিষয়ে টীকা হাজির করা আবশ্যক। সিনেমাকে একটা শিল্প হিসাবে দেখার প্রসঙ্গকে বৌদ্ধিকভাবে অনেক গুরুত্ব দিয়ে থাকি আমি। বাংলায় কাকতালীয়ভাবে ‘শিল্প’ কথাটির সুস্পষ্ট দুইটা অর্থে ব্যবহৃত হয় – ইন্ডাস্ট্রি আর আর্ট। কেবল দুইটা অর্থ থাকলে অতটা বিপর্যয় হতো না, যদি সংশ্লিষ্ট ব্যবহারকারীরা সজাগ থাকতেন কখন কোথায় মনোযোগ অধিক থাকা প্রয়োজন। আগেও যেমনটা বলেছি, বাংলাদেশের মধ্যবিত্তীয় সিনেমার আলাপচর্চা মোটের ওপর নন্দনকে ঘিরে আবর্তিত। সেটা পদ্ধতিগত সমাজ গবেষকের জন্য বিরক্তিকরই নয় কেবল, উপরন্তু অসুবিধাজনকও বটে। একটা কারখানা হিসাবে চলচ্চিত্রকে দেখতে না-পারা এর রূপান্তর, ক্ষয়, অবনয়নকে অনুধাবন করতে দেয় না। উপরন্তু, এর মধ্যকার নানান পক্ষকে উদ্ঘাটন করতে দেয় না; তাঁদের সামাজিক জীবন প্রসঙ্গে কোনো বোঝাপড়াও তাতে বিঘ্বিত হবার কথা। এইভাবে দেখাকেই মোটের ওপর ‘পলিটিক্যাল ইকনমি’কেন্দ্রিক দেখাদেখি বলছিলাম এর আগে; বাংলাদেশে তথা ঢাকায় যেটা সিনেমা পর্যালোচনার দৃষ্টিভঙ্গিতে গুণগতভাবে অনুপস্থিত।

মোটামুটি তিনটা ভাষামালা বা ডিসকোর্স ধরে প্রচলিত ব্যাখ্যাগুলোকে সাজানো যায়: ‘ছবির মান ভালো না হওয়ায় দর্শক হল ছেড়ে গেছেন’, ‘অশ্লীলতার কারণে সাধারণ দর্শক আর হলে যান না’, ‘হলের পরিবেশ খারাপ হ্ওয়ায় দর্শকেরা আসেন না’। এর মধ্যে প্রথম দুটো খুবই সম্পর্কিত, এমনকি পরিশেষে একটা প্রস্তাবনারই দুটো প্রকাশ। আবার শেষোক্তটা দুই ভিন্ন অর্থে প্রকাশিত হয়ে থাকতে পারে – প্রেক্ষাগৃহের ভৌত স্থাপত্যীয় বিনাশ এবং প্রেক্ষাগৃহের আশপাশে সামাজিক প্রতিবেশ। তিনটার ক্ষেত্রেই কারণ হিসাবে হাজির হচ্ছে এমন সব ঢিলাঢালা প্রস্তাবনা যেগুলো নিজগুণেই অন্যান্য নানাবিধ বিষয়াদির ফলাফল হবার কথা। তবে ‘হলের পরিবেশ’ বছর ২০-৩০ আগেও মফস্বলে একটা আলাপিত প্রসঙ্গ ছিল। তখন মূলত বোঝানো হতো সিনেমা হলকে কেন্দ্র করে এলাকার ‘পুরুষ-তরুণ’দের জটলা-হল্লা-কর্মকাণ্ডকে। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে এই জটলা-হল্লাগুলোকে কমবেশি ‘বখাটে ছেলেদের তৎপরতা’ হিসাবে দেখা হয়ে এসেছে; এবং পরিবারের মেয়েদের প্রতি সম্ভাব্য আক্রমণকারী হিসাবে। প্রচুর বাস্তবিক উদাহরণই আছে যেখানে নানান বয়সের নারীদের সাথে হয়রানিমূলক আচরণগুলো এসব এলাকায় সংঘটিত হয়েছে। উত্তরকালে প্রশাসন ও মিডিয়া সাব্যস্ত করেছে যাকে ‘ইভটিজিং’ হিসাবে সাব্যস্ত করেছে সেগুলোই মূলত সিনেমা হলের পরিপার্শ্ব ও চত্বরকে ‘খারাপ পরিবেশ’ হিসাবে চিহ্নিত করার কারণ। সেটা কালক্রমে বদলেছে। সিনেমা হলগুলোতে ব্যবসা মন্দা চলতে থাকাতে অধিকাংশ হলেরই পুনর্সংস্কার ঘটেনি। স্থাপত্য, প্রক্ষালণ ব্যবস্থা, আসন সকল কিছুরই দুর্দশাগ্রস্ত একটা দশা চলমান। বর্তমানে ‘পরিবেশ’ বলতে এটাকেও উল্লেখ করা হয়।

ছায়াছবির মান কিংবা অশ্লীলতাকেন্দ্রিক কারণ আবিষ্কার করা নেহায়েৎ খাপছাড়াই নয়, বরং তা সিনেমা হলগুলোর ইতিহাসের সাথেও বেমানান। যেসব ছবি ৯০ দশকে বা তারও পরে ‘অশ্লীলতা’র দায়ে অভিযুক্ত সেগুলোর উপাদান অজস্র পুরান ছায়াছবিতে বিদ্যমান ছিল যেগুলো লাগাতার সিনেমা হলে চলেছে এবং অনেকগুলো প্রচলিত অর্থে বাণিজ্য-সফলও হয়েছিল। একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য ঘটে গেছে ক্র্যাফটে বা নির্মাণশৈলীতে। যৌনতা কিংবা সহিংসতানির্ভর ছায়াছবির বেলাতেও নির্মাণশৈলী গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। দর্শক যতই ‘সাধারণ’ হোন না কেন, তিনি প্রেক্ষাগৃহের পর্দায় কোনো ছবির নির্মাণে মুন্সিয়ানা থাকা বা না-থাকাকে অনায়াসে শনাক্ত করতে পারেন। যদি আদৌ কিছু দর্শক এসবের কারণে উৎসাহ হারিয়েও ফেলেন, তবুও তার কারণ ‘অশ্লীলতা’ বা ‘নোংরা’ নয়; খোদ নির্মাণশৈলীর অভাবে ছায়াছবির ধ্যাবসা হয়ে পড়া। তাছাড়া, এমনকি চলচ্চিত্র শিল্প যখন ধ্বসে পড়েনি তখনও বিভিন্ন হলে ইংরাজি সফট-পর্ন ছায়াছবি চলত, সেগুলোর আমদানিকারকেরা এতে লাভবান হতেন বলেও তথ্যপ্রমাণ আছে। ফলে যৌনতার উপাদানের কারণে লোকজন বিরক্ত হয়ে হল ছেড়ে দিয়েছেন এরকম দাবিনামা একটা উদ্ভট ভ্রান্ত প্রচারণা মাত্র। আমার বিবেচনায় এটা মনে রাখা দরকার যে প্রেক্ষাগৃহে নানান ধরনের বিষয়বস্তু ও রুচির দর্শক আছেন। এমনকি একই দর্শক বিভিন্ন কালে বিভিন্ন রুচির গ্রহীতা হয়ে থাকেন। একটা সমাজ-মিলনায়তন হিসাবে সিনেমা হলের সর্বাত্মকভাবে বিনাশ ঘটেছে। সেই বদলটা মুখ্যত ইন্টারফেইস বা অন্তর্কাঠামোর বদল। মফস্বলে লম্বা সময় ‘আইসমিল’ বা ‘রাইসমিল’-এর মালিকেরা ধনী লোক বলে বিবেচিত হতেন। নতুন পুঁজিবাদে স্থানীয় এসব মিল-কারখানার লোকজন অনায়াসে আগের মুনাফা করতে পারছেন না। এটা ‘আইস’-এর প্রতি কোনো ‘রুচিবিদ্রোহ’ নয়, বরং বৃহদায়তন কোল্ড স্টোরেজের উত্থান এবং জাতীয় পর্যায়ের আইসক্রিম শিল্পের সর্বাত্মক বিকাশ ও বিপণন হিসাবে দেখতে হবে। একইভাবে, চলচ্চিত্রের বিষয়েও এরকম সরল স্থূল পরিকাঠামো থাকা বিপজ্জনক।

সামাজিক মিলনায়তনের এপিটাফ আর নতুন যুগের সিনেমা

সামাজিক মিলনায়তন হিসাবে সিনেমা হলের অবনয়ন এমনকি সর্বাত্মক বিনাশকে স্বীকার করা এই গবেষণার একটা মৌলিক ফলাফল। আগের অধ্যায়ে যখন সিনেমা শিল্পের ধ্বংসের প্রসঙ্গ আলোচিত হচ্ছিল, তখন এটা একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতি, পরিপ্রেক্ষিত ও পরিকাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত প্রসঙ্গ হিসাবে অনুধাবন করে করা হয়েছিল। এখানে স্পষ্ট করা দরকার যে বাংলাদেশী সিনেমা শিল্পের ধ্বংস মানেই সিনেমা নির্মাণের অবলোপ নয়, কিংবা দর্শকের পড়তি নয়। বরং, ধ্বংসকে পাঠ করতে হবে অন্তত কয়েকটা উপায়ে: একটা নির্দিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থায় যেভাবে স্থানীয় সিনেমা বানানো হতো সেই ব্যবস্থার গুরুতর অবনতি; সেই ব্যবস্থাটা কারখানা হিসাবে যত মানুষের যেভাবে জীবিকা সরবরাহ করে এসেছিল সেটা করতে ব্যর্থতা; ছায়াছবি প্রদর্শনকারী যে পেশাজীবীরা, হল মালিক ও তাঁর কর্মচারীবৃন্দ, তাঁদের পেশাজীবনের অনিশ্চয়তা; কলাকুশলীদের তারকামূল্য ও অর্থমূল্যের পড়তিদশা; লাগাতার নিন্দামন্দের একটা সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া হিসাবে উল্লেকৃত হতে-থাকা ইত্যাদি। যেহেতু সিনেমা একটা বৈশ্বিক ব্যবস্থা, তাই স্থানীয় সিনেমার নিপতন ও চলচ্চিত্র সেবনের কোনোরকম সূচক নির্দেশ করে না। বরং, সাংস্কৃতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক উঁৎপাদের মধ্যে চলচ্চিত্রই সম্ভবত সবচেয়ে বৈশ্বিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, এমনকি সঙ্গীতের থেকেও কারো কারো মতে। ফলে, যদি আমরা আন্দাজ করে নিই যে ঘরে-ঘরে মধ্যবিত্ত দর্শকেরা স্থানীয় ছায়াছবির সঙ্গে পর্যাপ্ত ঘৃণামূলক দূরত্ব তৈরি করেছেন, তাহলে একই সঙ্গে আমাদের আন্দাজ করে নিতে হবে তাঁরা ব্যাপকহারে হলিউডি, স্প্যানীয়, ফরাসী, ভারতীয় ছায়াছবি ভোগ/কনস্যুম করছেন। ওপরন্তু, স্যাটেলাইট টেলিভিশন প্রযুক্তি ও তার বাজারকে যখন সর্বাত্মক ক্ষমতাময় মনে হচ্ছিল, তখনই এর থেকেও শক্তিশালী দৃশ্য-পাটাতন হিসাবে ইন্টারনেট বৈশ্বিক পরিষেবা বাণিজ্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এই রূপান্তরের বৈশিষ্ট্য বহুবিচিত্র, সর্বগ্রাসী এবং এর সম্ভাবনা দূরবর্তী দর্শক পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্য আর কোনো মানদণ্ড বা সূচক যদি বিবেচনা নাও করি, পর্দার মাপের বিচারেও এই নয়া-পাটাতন ৩ ইঞ্চি থেকে ৭৫ ইঞ্চি পর্দা কিংবা তার থেকেও বিশালাকায় দৃশ্যপ্রক্ষেপ বা প্রজেকশনে সমর্থ। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে চলচ্চিত্র শিল্পের ক্ষয়ক্ষতিকে গুরুতরভাবে স্থানীয় হিসাবে দেখতে হবে। চলচ্চিত্রকেও নিছক পূর্বতন সংজ্ঞাকাঠামোতে বন্দি রাখার মানে নেই। আমি দীর্ঘকাল ধরেই দৃশ্য-উৎপাদন ও দৃশ্যের ভোগপ্রণালী ধারণাগুলো প্রয়োগ করছি। চলচ্চিত্র একদা একমাত্র ‘পাবলিক’ দৃশ্যাবলী সরবরাহক ছিল – ম্যুভি যে অর্থে। এখন নানাবিধ দৃশ্যমণ্ডলীর অংশ হিসাবে চলচ্চিত্রকে উপলব্ধি করা বিশ্লেষকদেরও প্রয়োজন।

স্টার সিনেপ্লেক্সের মহাখালী আউটলেট

কেন ও কীভাবে সামাজিক মিলনায়তন হিসাবে প্রেক্ষাগৃহ আর বলবৎ রইল না তার সহজ উত্তর আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব। সেই উত্তর হলো রাষ্ট্র ও জনসমাজের মধ্যকার সম্পর্ককে রাষ্ট্র পুনর্নির্ধারণ করেছে। আবার, যেসব জটিল সব পূর্বানুমান আর সংশ্লেষ ঘটিয়ে আমার এই প্রস্তাব, তার মাত্রাগুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম। ফলে, সম্ভবত বিশদ না করলে এই প্রস্তাবটারও বিশেষ কোনো অর্থ অনেক পাঠকে করবেন না। আমি বিশদ করার জন্য প্রথমেই মনে করিয়ে দিই যে বিভিন্ন লোকালয়ে, ছোট শহরগুলোতে আরও বিশেষভাবে, সিনেমা হলগুলো জন-জমায়েত কেন্দ্র। ‘পাবলিক-কনসাম্পশন স্পেস’। এরকম মিলনায়তনগুলো সবই এই কাতারে রাখতে প্রস্তাব করছি আমি – গণ গ্রন্থাগার বা পাবলিক লাইব্রেরি, পার্ক বা উদ্যান, বিয়েবাড়ি বা ‘কম্যুনিটি’ সেন্টার, শিল্পকলা কিংবা পৌরসভা মিলনায়তন ইত্যাদি। চমকে যাবার মতো নয়, তবে মনোযোগ দেয়া দরকার, এখানে এই পরিসরগুলোর মালিকানা নানাবিধ ব্যবস্থায় ক্রিয়াশীল ছিল। এখানে রাষ্ট্রায়ত্বগুলো খুবই স্পষ্ট, তা লাইব্রেরি হোক বা শিল্পকলা হোক। ব্যক্তিমালিকানাধীনগুলোও আপাতগ্রাহ্যে খুব স্পষ্ট, যেমন বিয়ের অনুষ্ঠান হয় এরকম কম্যুনিটি সেন্টার। এই পদবাচ্যটি এমনই সর্বদেশীয় অর্থ তৈরি করেছে যে সারা বাংলাদেশে একদম ছোট লোকালয় থেকে বৃহৎ মহানগরে একই পদবাচ্য দিয়ে এই দলগত ব্যবহারযোগ্য পরিসরটি গড়ে উঠেছে। মালিকানার প্রসঙ্গে অন্তত ‘কম্যুনিটি সেন্টার’গুলো অতটা সরল ব্যক্তিমালিকানা দিয়ে বোঝা যাবে না; বিশেষত মহানগরের বেলায়। বরং, ব্যক্তিমালিকানাধীন হবার পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারী আধা-সরকারী কর্মচারিদের ডিজাইন করা সামাজিক জীবনে ‘আবাসব্যবস্থা’র পাশাপাশি আচার-অনুষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট পরিসর ঠিক করা এমনকি ৫০ বছর আগের জনপ্রশাসনের মধ্যেই ছিল। ফলে, সভাসমিতির জন্য মিলনায়তন বানানোর পাশাপাশি বিয়াশাদীমূলক অনুষ্ঠানের জন্যও মিলনায়তন বানানো হতো। বরং, পাঁচ-ছয় দশক আগের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাতে দুই ধরনের (সভাসমিতি ও বিয়াশাদী) আয়োজনের জন্য অখণ্ড মিলনায়তন অনুধাবিত ছিল। বৃহত্তর কর্পোরেশন পুঁজির উত্থানে বরং এগুলো সব সুনির্দিষ্ট পরিসর হিসাবে পুনর্সংজ্ঞায়িত হয়েছে। এখানে কিছুতেই বোর্ড মিটিংয়ের পরিসর বিয়াশাদীর পরিসর নয়; আবার বার্ষিক পুনর্মিলনীর জন্য হয়তো কোনো পরিসর নির্দিষ্ট হয়ে থাকবে সেখানে পরিচালকদের কোনো নীতি-নির্ধারণী বৈঠক হবে না। নতুন এসব ভাবনার সঙ্গে মানানসই স্থাপত্যও সুলভ। একটা অখণ্ড চত্বরে বিলাস বা প্রমোদের জন্য উদ্যান বা চৌবাচ্চা থাকবে, বিয়েশাদীর মতো অনুষ্ঠানের জন্য হলঘর থাকবে, আবার রুদ্ধদ্বার বৈঠকের জন্য ‘কনফারেন্স ঘর’ থাকবে।

সারাংশ হলো, রাষ্ট্র ও প্রশাসক সাধারণ অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাধর প্রজাদের জড়ো হবার জন্য নানাবিধ পরিসরের আয়োজন করে, ঐতিহাসিকভাবেই। এর সঙ্গে নয়া নয়া পুঁজি ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত হয়ে থাকে, এবং হয়ে পড়ে। সিনেমা হল সম্ভবত এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ যেখানে নতুন প্রযুক্তি ও ছবিকেন্দ্রিক পুঁজিবাদের পণ্য (এখানে পরিষেবা) খোদ জন-পরিসরের নির্মাতা হয়ে পড়েছিল। ‘ব্যক্তি’ উদ্যোক্তা খোদ ‘জন-পরিসরীয়’ রাষ্ট্রীয় তাগিদের স্বার্থ বহন করতে পেরেছিল। নিখিল বিশ্বে এই ধরনের জন-জমায়েতের অনুশীলন কমবেশি একশ খানেক বছরের অনুশীলন। বৈশ্বিক ইতিহাসকে আমলে নিলে থিয়েটার-জমায়েত এর থেকে অনেক প্রাচীন। নতুন প্রযুক্তি ও পুঁজিতে নতুন ধরনের ব্যবস্থাপনায় নতুন দামে পরিষেবা হাজির করার নজির নানান রাষ্ট্রে আছে। হলিউডের ছবির বাজার প্রেক্ষাগৃহ পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে, প্রজেকশন যাই বদলাক না কেন; একই কথা ভারতের ক্ষেত্র্ওে খাটে। যতই সামাজিক শ্রেণীগত মাত্রা থাকুক, নির্দিষ্ট শর্তে ‘জন’-জমায়েত হিসাবে সিনেমা হল বিরাজমান থেকেছে, এখনো আছে। বরং, আন্তর্জাতিক এসব উৎপাদ/প্রডাক্ট সুলভ হওয়াতে, আর স্থানীয় প্রডাক্ট ক্র্যাফট আর রূপান্তরযোগ্যতায় ‘টিঁকতে না পারাতে’, নানান মাত্রার রুচির ও সামাজিক শ্রেণীর দর্শক সেগুলোকে ভোগ/সেবন করছেন। সেলফোনের পর্দা থেকে বিশাল ড্রইংরুমের বিশাল পর্দায় প্রজেকশনের মাধ্যমে। সিনেমা হলের অবলোপ মুখ্যত শ্রেণীনির্দিষ্ট ‘অক্ষম’ দৃশ্যগ্রহীতাকে দৃশ্যসেবনের জায়গা থেকে স্থানচ্যুত করেছে। আবার অন্যদিকে, নতুন ভোগ্যপণ্যের মূল্যপ্রদানসাপেক্ষে পুনরায় তাঁকে খরিদ্দার বানানোর সকল সম্ভাবনাই এতে জারি থাকছে। পানির মতো সুলভ বস্তুকে পর্যন্ত সকলের জন্য পণ্য বানানো গেছে, দৃশ্যকেও যাচ্ছে।    

সহায়ক রচনাপঞ্জী

“এক বছরেই অর্ধেক সিনেমা হল বন্ধ,” বিনোদন, প্রথম আলো, ০১ নভেম্বর ২০১৯।

“সারাদেশে এখন সিনেমা হল মাত্র ৭০টি!,” ডেইলিস্টার বাংলা নেট ভার্সন, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০।

মানস  চৌধুরী, “চলচ্চিত্র বিষয়ক এজেন্ডাটা কী,” ঢাকা পোস্ট, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১। https://www.dhakapost.com/opinion/8957

মানস  চৌধুরী, “এন্টি-সিনেমা মেনিফেস্টো,” বিসিটিআই প্রাক্তনী সংসদ সিনেমা আলাপ, পর্ব-০৭, ১০ জুন ২০২১।

মানস চৌধুরী, “ঢাকা মহানগরের নয়া সাংস্কৃতিক লালনকেন্দ্র (কালচারাল হাব) এবং কর্পোরেট প্রভাব,” [অপ্রকাশিত গবেষণা, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ২০১১]।

মানস চৌধুরী, “বটবৃক্ষছায়া: সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, ঢাকাই সাংস্কৃতিক লালনকেন্দ্র ও কর্পোরেট উত্থান,” নৃবিজ্ঞান পত্রিকা, সংখ্যা ১৪, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা, ২০০৮।

মানস চৌধুরী, “সোনাবন্ধুর পিরীতি ও ভালবাসার সুশীল ডিসকোর্স,” এস এম নুরুল আলম, আইনুন নাহার ও মানস চৌধুরী সম্পাদিত সাম্প্রতিক নৃবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ২০০০।

মানস চৌধুরী, “সূক্ষ্ম প্রেমের অর্থ: নিম্নবর্গীয় গানে যৌনতা ও নারীর আত্মসত্তা,” জহির আহমেদ ও মানস চৌধুরী সম্পাদিত চর্চা: নৃবিজ্ঞানের প্রবন্ধ সংকলন, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ২০০১।

Apadurai and Breckenridge, Carol A.  1988: Why Public Culture?. Public Culture, 1 (1): 5-9 

Chowdhury, M. 2021: Of Leisured Lifestyle: Cyber-dwellers of Dhaka City in the Lockdown. Society and Culture in South Asia. Special Covid-19 Issue, Delhi: Sage.

Chowdhury, M. 2008: Can there be an ‘Art History’ in the South?. Journal of Social Studies. Issue 122, Dhaka: Centre for Social Studies

Chowdhury, M. 2003: Bangladeshe Civil Shomaj: Mohanogor-Modhdhobitter Goshthibodhdhotar Noya Probonota (Civil Society in Bangladesh: Oligarchy of Metropolitan Middleclass). Jogajog,  Issue 6. Dhaka.

During, S. (ed) 1993: The Cultural Studies Reader. London: Routledge.

Evans, J. and Hall, S. 1999: Visual Culture: The Reader. London: Sage and Open University Press.

Fiske, J. 1989a: Understanding Popular Culture. Boston, MA: Unwin Hyman.

Green, Emily H. (ed) 2018: Consuming Music: Individuals, Institutions, Communities, 1730-1830. Cambridge: Boydell & Brewer.

Hayward, S. 2017: Cinema Studies: The Key Concepts. London: Routledge.

Hall, S. (ed.) 1991: Representation: Cultural Representations and Signifying Practices. London: Open University Press and Sage.

Hall, S. and Whannel, P. 1964: The Popular Arts. London: Hutchinson Educational.

Haq, F. 2020: Cinema in Bangladesh: A Brief History. Dhaka: Nokta.

Roy, Ratan K. 2020: Television in Bangladesh: News and Audience. London: Routledge.


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মানস চৌধুরী

লেখক, শিক্ষক ও নৃবিজ্ঞানী

মন্তব্য করুন