2‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এর সেই বিখ্যাত দৃশ্যই যেন ফিরে এসেছে। তবে হিটলারি গোঁফে চার্লি চ্যাপলিন নেই। বদলে আস্ত একটি গ্লোব নিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিমায় নৃত্যরত যাঁকে দেখা যাচ্ছে, তিনি নরেন্দ্র মোদী। চ্যাপলিনের ছবিতে যেমন আছে, মোদীর বেলুনও শেষে চুপসে যাবে।

কার্টুন ছবির এমন একটি ভিডিও এখন নেট-রাজ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে ইন্টারনেটে ব্যঙ্গচিত্র ছড়িয়ে এক সময় গ্রেফতার হয়েছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্র। ভোটের মরসুম আসতেই কিন্তু দলমত নির্বিশেষে নেতা-নেত্রীদের নিয়ে রঙ্গব্যঙ্গে মেতে উঠছেন নেটিজেনরা। নানা ধরনের চুটকি তো আছেই। সেই সঙ্গে নেট দুনিয়ার নতুন ঢেউ কার্টুন-ভিডিও।

শোলে-য় জয় (অমিতাভ বচ্চন) আর মৌসি (লীলা মিশ্র)-র মজাদার দৃশ্য এখানে পেশ হচ্ছে নয়া ঢঙে। ভিডিওতে বিয়ের ঘটকালির বদলে জয় দেশের সব থেকে পুরনো পার্টির হয়ে সওয়াল করছেন। বলছেন, মিলেজুলে সরকার গড়া, সাংসদ কেনা-বেচার কত না হ্যাপা! তা ছাড়া মন্ত্রীদের একবার দুর্নীতির অভ্যেস হয়ে গেলে দলই বা কী করবে? জয়ের মুখে বীরুর চরিত্রের ফিরিস্তি শুনে মৌসির যা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, এ ক্ষেত্রেও ক্ষোভ ততটাই উথলে উঠছে।

আইআইটি স্নাতক কেজরীবালকে বাবুজি অলোকনাথের স্বপ্নাদেশের ভিডিও ইতিমধ্যেই লাখো বার নেট-নাগরিকদের আঙুলের ডগায় ঘুরেছে। মধ্যবিত্ত ইমেজ গড়তে বাবুজি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার বাতিল করে ‘কেজরু’কে ঝাঁটার প্রতীক বেছে নিতে বলছেন। ফুলহাতা সোয়েটার, মাফলার, নেহরু টুপি— সবই মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের গয়নাগাঁটি হয়ে উঠছে।

‘দিওয়ার’-এর অমিতাভ-শশীর বহুচর্চিত দৃশ্যটিও উঠে আসছে ২০১৪-র পটভূমিতে। সেতুর নীচে এ বার মুখোমুখি মোদী ও কেজরীবাল। মোদী কিছুটা দেরিতে এসে দুঃখপ্রকাশ করলে অরবিন্দের চিমটি, “এত খোয়াব দেখলে কী করেই বা আগে পৌঁছবে!” মোদীর আস্ফালন, “তুমি তো ৫০ দিনও সরকার চালাতে পারো না, আছে কী তোমার যে তখ্তে বসবে?”

শেষ কথা কেজরীবাল বলেন। ‘‘আসলে আমার কাছে কিছুই নেই! কিন্তু এটা শুধু তুমি জানো, আর আমি জানি। কিন্তু পাবলিক জানে না!’’ হতভম্ব মোদী মোবাইলে কেজরীবালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেন। ‘‘অপারেশন পেস্টকন্ট্রোল শুরু করো! ক্লিন চিট আমি আদায় করে নেব।”

ভোটের হাওয়ায় এমন রঙ্গব্যঙ্গের সঙ্গে আম বাঙালির আলাপ-পরিচয় অবশ্য চিরকালই ছিল। সে-কালে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৌতুক নকশা রাজনীতি নিয়ে কটাক্ষে ভরপুর ছিল। মৃতদেহের অধিকার দাবি করে দু’টি দলের দড়ি টানাটানি প্রসঙ্গে ভানুর সংলাপ, ‘এ মড়া আমার মড়া’, এখনও কারও কারও মনে পড়ে। ভোট-শিকারীদের নিয়ে দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের প্যারডি, ‘আয় ভোটার আয়, মাছ কুটলে মুড়ো দিব, গাই বিয়োলে দুধ দিব’। সলিল চৌধুরীর ‘নন্দলাল দেবদুলাল’-এর গানের সৎপাত্রটির সাত খুন মাফ, কারণ সে ‘এ বার ইলেকশনে দাঁড়িয়েছে মন্ত্রী হবে বলে!’ ইন্দিরা-জমানার পতন-পর্বে অন্নদাশঙ্কর রায় লেখেন, ‘ফাঁপা তাসের কেল্লা রে ফাঁকা তাসের কেল্লা’!

কিন্তু ছড়া-প্যারডি-চুটকি ছাড়াও ভিডিওর প্রয়োগ এ বার এই ট্র্যাডিশনে নতুন মাত্রা জুড়েছে। বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞ প্রসূন জোশীর মতে, “এটা অবশ্যই ভোটের নতুন দিক।” ইউ টিউবে নিজের বাচ্চার দুষ্টুমির ছবি আপলোড করার ঢঙেই যে কেউ এখন রাজনৈতিক প্রচার বা রঙ্গব্যঙ্গের ভিডিও ছেড়ে দিতে পারেন। মুম্বইয়ে বিজ্ঞাপন জগতের পেশাদার সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “একে প্রচারের গণতন্ত্রীকরণ বলাই যায়।” ভিডিও ছবি বা অ্যানিমেশনের ছোট্ট ইউনিটের অনেকেও নজর কাড়ছেন। বিভিন্ন অ্যাড এজেন্সি বা সরাসরি দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেও অনেকে কাজ করছেন বলে জানাচ্ছেন প্রসূন-সুমন্তরা। ইস্ট ইন্ডিয়া কমেডি বা ঢোল কে পোল-এর ভক্ত হু-হু করে বাড়ছে। মুখ্য চরিত্রে অবশ্যই মোদী, রাহুল বা কেজরীবাল।

গুজরাত পর্যটন নিয়ে বচ্চনী বিজ্ঞাপনের প্যারডিও ‘ভুয়ো উন্নয়ন’ (ঝুঠি বিকাশ)-এর গল্পকে ব্যঙ্গ করছে। রাহুলের নেতৃত্বকে ব্যঙ্গ করে প্যারডি শোনা যাচ্ছে, দিল তো বাচ্চা হ্যায় জি / লিডার কচ্চা হ্যায় জি! ব্যাটম্যান-সুপারম্যানের আদলে মোদীর কার্টুন সংস্করণ, ফেকুম্যানের বেশ দাপট। ‘মোদী আনেওয়ালা হ্যায়’-গানের প্যারডি হয়েছে ‘ফেকু জানেওয়ালা হ্যায়’! রাহুলের ডাকনাম, পাপ্পু! একটি ভিডিওয় মুখ্যমন্ত্রী কেজরীবালের কাণ্ডকারখানা চুপিচুপি দেখছেন ফেকু ও পাপ্পু। কেজরীবালের নাম সেখানে ট্র্যাজেডিওয়াল।

বাস্তবে আপ নেতারা কেজরীবাল-চুটকিকে স্বাগত জানালেও কংগ্রেস-বিজেপি কিন্তু নেতানেত্রীদের নিয়ে রসিকতা খুব ভাল চোখে দেখেনি। ইন্টারনেটে এই নিয়ে ঝগড়াও বেশ জমেছে। তবে দিল্লিতে সরকার গড়ার এই ভোটে বাংলার রাজনৈতিক লড়াই নিয়ে চুটকি ভিডিও বা কৌতুক নকশা কার্যত নেই বললেই চলে।

কেন? হাস্যকৌতুক শিল্পী মিরের কথায়, “প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, এই চর্চাটাই এ বার বেশি হচ্ছে। আপ-ও বড় দলগুলোর সঙ্গেই টক্কর দিচ্ছে।” মিরের আশা, পরে আঞ্চলিক দাবি-দাওয়া মাথা চাড়া দিলে বাংলার কথাও নিশ্চয়ই রঙ্গব্যঙ্গে উঠে আসবে!