ভুলগুলো ঝরে যাক, মসৃণ হউক আগত সময়

Slider টপ নিউজ সম্পাদকীয়

তৃনমূল থেকে উঠে আসা একজন কর্মী, অপেক্ষাকৃত কম সময়ে জীবনের একটি বড় প্রাপ্তি শিকার করেছেন তার কর্মগুণে। ভাল কাজগুলোর বদৌলতে তার আজকের এই অর্জন। গাজীপুর মহানগরের কানাইয়া গ্রামে নানার বাড়িতে বড় হওয়া জাহাঙ্গীর আলম, ৩৯ বছর বয়সে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আয়তনের মহানগর, গাজীপুর মহানগরের মেয়র হয়েছেন। বলতে দ্বিধা নেই যে, জাহাঙ্গীর আলম সাবেক সংসদ সদস্য. সাবেক মেয়র সহ বেশ নামী-দামী ও জনপ্রিয় নেতাদের হারিয়ে মেয়র হলেন।

২০০৯ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যান হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। এবার তিনি যে ভোট পেয়েছেন, তাও বাংলাদেশের সকল সিটি মেয়রদের প্রাপ্ত ভোট থেকে বেশী।

এ ছাড়া বাংলাদেশে যে পরিমান ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য হয়, তার চেয়ে বেশী ভোট জাহাঙ্গীর আলম পেয়েছেন বলেই মনে হয়। ইতিহাস দেখলে বলতে হবে, নূন্যতম প্রাপ্ত ৫/৭ জন সাংসদের ভোট পেয়ে মেয়র হয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম। নিঃসন্দেহে এই অর্জন জাহাঙ্গীর আলমের জন্য একটি বড় প্রাপ্তী। এখন দেখা যাক তিনি কেমন সেবা করতে পারেন। তিনি কেমন সেবক হতে পারেন। তিনি সেবক না শাসক হবেন! সময় বলে দেবে।

অর্জন যত সহজ, রক্ষা তত সহজ নয়। এই অমিয় বাক্যকে ভুল প্রমান করতে হবে জাঙ্গীর আলমকে। তাকে প্রমান করতে হবে, অর্জন ও রক্ষা দুটোই সহজ। এই সূত্রকে মাথায় নিয়ে তিনি কাজ করছেন এতে কোন সন্দেহ নেই।

ইতিহাস বড়ই কঠিন। ইতিহাস সুন্দর। ইতিহাস নির্মমও। প্রতিটি মানুষ ও কাজ একটি ইতিহাস। তবে জাহাঙ্গীর আলমও একটি ইতিহাস ইতোমধ্যে হয়ে গেছেন।

মানুষ যখন সেবাকর্মী হয়, তখন তার নিজের ও কাজের সমন্বয়ে গঠিত হয় একটি ইতিহাস। এই ইতিহাস ভবিষৎকে নির্দেশনা দেয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ওই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়।

একজন কর্মী থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মহানগরের অধিকর্তা। এটি একটি বিশাল অর্জন। সরকারী মর্যাদায় রাজনৈতিক কারণে উপমন্ত্রীর পদমর্যাদা পেলেও প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় উন্নীত হবেন গাসিকের মেয়র বলে আশা আছে। একজন রাজনৈতিক কর্মী থেকে সরাসরি একজন উপমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর গাড়িতে উঠা অনেক কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময় নিঃসন্দেহে। এই অর্জনকে ধরে রাখতে যে পরিমান ত্যাগ ও ধৈর্য ধারণ করতে হবে তা জাহাঙ্গীর আলম পারবেন বলে আশা আছে।

ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষন বলছে, জাহাঙ্গীর আলম তৃনমূল থেকে সরাসরি উপমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় উন্নীত হয়েছেন, এটা গর্বের বিষয়। তবে বাস্তবতা বলছে, জাহাঙ্গীর আলম মেয়রের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে জবাব দিহিতার মধ্যে এসেছেন আগের থেকে বেশী। একজন সাধারণ নাগরিকের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও একজন নির্বাচিত মেয়রের সামাজিক দায়বদ্ধতর মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। একজন জনপ্রতিনিধি যখন একাধিক নাগরিকের ভোটে নির্বাচিত হন, তখন ওই সকল নাগরিকের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা অধিকারসহ নিশ্চিত করার দায়িত্ব এসে যায় ওই জনপ্রতিনিধির কাছে। নিজের ও ভোটারদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা নিয়ে পথ চলতে হয় জনপ্রতিনিধিকে। জাহাঙ্গীর আলম একজন তৃনমূণ কর্মী থেকে উঠে এসে সরাসরি বড় জনপ্রতিনিধি হয়ে উপমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর পদে আসিন হয়েছেন বলেই তার দায়িত্ব ও কর্তব্য অপরিসীম। নিজেকে নিয়ে ভাবার সময়েই এখন তাকে ভাবতে হবে প্রায় অর্ধকোটি মানুষকে নিয়ে।

অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে তাকে সামনে যেতে হবে, আর এই ধারণা সব সময় সামনে না থাকলে তিনি পরাজিত হবেন এটাও সত্য, যা ইতিহাস প্রমান দিয়েছে বার বার। সুতরাং জীবনের শুরু থেকে মেয়র হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ভুল গুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে ও ভাল কাজগুলোকে এক সাথে করে পথ চলতে হবে তাকে। কারণ জাহাঙ্গীর আলম এখন একা নয় তিনি অর্ধকোটি মানুষের অভিভাবক। বলা যায়, তিনি এখন বন্দি অর্ধকোটি মানুষের কারাগারে।

সাধারণ পর্যবেক্ষন বলছে, সাধারণ মানুষের গোপন মতামত জানতে না পারলে নেতাদের সামনের দিনগুলো ভুলে ভরা থাকে। তাই প্রশংসাকে কম প্রাধান্য দিয়ে সমালোচনাকে বেশী প্রাধান্য দেয়া উচিত। যারা সব সময় প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকেন, তারা ভাল চায় না এটা সঠিক এবং ইতিহাসখ্যাত সত্য। যে বন্ধু সব কাজকে সমর্থন করেন, তিনি শত্রু, বন্ধু নয়। যিনি তৃতীয় ব্যাক্তির কথায় সরাসরি এ্যাকশনে যায়, তিনি বোকা। এ কথাগুলো পরীক্ষিত। বিপদে যারা পাশে থাকে, সুসময়ে তারা দূরে সরে যায় এটাও সত্য। সুসময়ে যারা মৌ-মাছির মত ভীড় করেন, মনে রাখতে হবে, খারাপ সময়ে তারা শত্রু ছিলেন। তাই ভাল মন্দ ভাল ভাবে না বুঝে কাজ করা বিপদের সংকেত দেয় সব সময়।

সম্প্রতি কিছু ঘটনা সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা মতের জন্ম দিয়েছে। নতুন মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে সে মতামত গুলো খুঁজে বের করে মূল্যায়ন করতে হবে। না হয় ভুলগুলো ঝরে না পড়ে আরো বড় বড় ভুলের জন্ম দিয়ে ঝড় হয়ে আসবে। যেমন কিছু মানুষ মনে করেন, নগর ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়রের দায়িত্ব নিয়ে রাজবাড়ি মাঠে যে কোন সংগঠনের ব্যানারে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মেয়র হিসেবে যোগদান করলে ভাল হত। গাজীপুর সিটিকরপোরেশনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত ওই অনুষ্ঠানের সভাপতিত্বটা জেলা প্রশাসক না করে সাবেক মেয়র বা কোন ডিপুটি মেয়র করলে ভাল হত।

যেহেতু গাজীপুর সিটিকরপোরেশন ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল সুতরাং অনুষ্ঠান পরিচালনা ও সভাপতিত্ব দুটোই তাদের করা দরকার ছিল। এটা না করে গাজীপুর সিটিকরপোরেশনের আয়োজনে দায়িত্ব গ্রহনের অনুষ্ঠান, নগর ভবন রেখে খোলা মাঠে না করাই ভাল ছিল। অনুষ্ঠানের স্বার্থকতা তখনি বাস্তব হত, যখন নগর ভবনে দায়িত্ব গ্রহন করে কোন সংগঠনের ব্যানারে অনুষ্ঠিত বরণ অনুষ্ঠানে মেয়র যোগ দিতেন। এটা না হওয়ায় সহসাই প্রশ্ন এসে যায়, ওই অনুষ্ঠানের বিশাল খরচ কে বহন করেছে? গাজীপুর সিটিকরপোরেশন না জাহাঙ্গীর আলম? তবে মানুষ জানে ওই খরচ জাহাঙ্গীর আলম করেছেন। যেহেতু গাজীপুর সিটিকরপোরেশন কর্তৃপক্ষের ওই অনুষ্ঠানের খরচ বহন করতে সাবেক পরিষদের অনুমোদন লাগত এবং গাজীপুর সিটিকরপোরেশনের সম্পূর্ন ব্যবস্থাপনায় ওই অনুষ্ঠান করতে হত।

এ ছাড়াও গাজীপুর সিটিকরপোরেশনকে এ ধরণের অনুষ্ঠান করতে হলে সাবেক পরিষদের সিদ্ধান্ত বা সরকারী কোন প্রজ্ঞাপন প্রয়োজন হত। এ সব কোন কিছু নিয়েই কথা হত না যদি না মেয়র সাহেব নগর ভবনে দায়িত্ব নিয়ে কোন সংগঠনের ব্যানারে অনুষ্ঠিত সংবর্ধনায় যোগ দিতেন।

এসব কথা বা অনুযোগগুলো সাধারণ মানুষের। যে কথাগুলো মেয়রকে কেউ বলবে না কোন সময়, সে কথাগুলো বলবে গণমাধ্যম, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গাজীপুরের প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যম কর্মীদের সীমাহীন ভালবাসায় সিক্ত জাহাঙ্গীর আলম মেয়র হওয়ায় তার বাধ্যবাধকতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পরামর্শ দেয়ার কাজটি, সহকর্মীরা অনেকটাই ভুলে গেছেন বলেই হয়ত কেউ এখনো বলেননি। তাই এ সব বিষয় মাথায় রেখে সামনে যেতে হবে। সমালোচনাকে আশির্বাদ হিসেবেই নিতে হবে এখন, কারণ জাহাঙ্গীর আলম বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মহানগরের মেয়র ও অর্ধকোটি মানুষের অভিভাবক বটে।

মানুষ আশা করে, একজন জাহাঙ্গীর আলম ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ৪ লাখ ১০জন ভোটারের ভোটে প্রায় ১২ লাখ মানুষের প্রতিনিধি এবং অর্ধকোটি মানুষের অভিভাবক।

মানুষ চায়,গাজীপুর সিটিকরপোরেশনের নতুন মেয়র আলহাজ এডভোকেট মোঃ জাহাঙ্গীর আলম অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে হাঁটবেন যেন হোঁচট খেতে না হয়, বহুদূর যেতে। এই সতর্কতা অবলম্বন করে অর্ধকোটি মানুষের হয়ে সামনে গেলে তিনি অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবেন বলে গাজীপুর মহানগরবাসীর প্রত্যাশা।

ড.এ কে এম রিপন আনসারী
গণমাধ্যম ও মানবাধিকার কর্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *